নাটোরে এবারও ১০৫ কোটি টাকার খেজুর গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা

নাটোরে এবারও ১০৫ কোটি টাকার খেজুর গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা

জেলায় মোট খেজুর গাছ রয়েছে ৬ লাখ ২৭ হাজার ৭৯০টি। এর মধ্যে রস সংগ্রহের উপযোগী গাছের সংখ্যা ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৬২২টি

 

এই শীত মৌসুমে জেলায় অন্তত ১০৫ কোটি টাকার খেজুর গুড় উৎপাদন হবে। রস আহরণযোগ্য ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৬২২টি খেজুর গাছ থেকে এই গুড় পাওয়া যাবে। জেলার ১০ হাজার ব্যক্তি খেজুর রস আহরণ ও গুড় তৈরিতে সংশ্লিষ্ট।

 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নাটোর জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় মোট খেজুর গাছ রয়েছে ৬ লাখ ২৭ হাজার ৭৯০টি। এর মধ্যে রস সংগ্রহের উপযোগী গাছের সংখ্যা ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৬২২টি। শীত মৌসুমের ৭৫ দিনে প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে ১৭৪ কেজি রস পাওয়া যায়। আর প্রতিটি গাছের রসে গুড় উৎপাদন হয় ১৭.৪০ কেজি।

 

জেলায় প্রতি মৌসুমে গড়ে প্রায় ৯,৬২৩ টন খেজুর গুড় উৎপাদন হয়। উৎপাদিত গুড়ের আর্থিক মূল্য অন্তত ১০৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি বছর নাটোর জেলায় ১০৫ কোটি টাকার খেজুর গুড় উৎপাদন ও বাজারজাত হয়। গত মৌসুমে প্রায় শত কোটি টাকার খেজুর গুড় উৎপাদন হয়েছিল।

 

জেলার সব উপজেলাতেই খেজুর গাছ থাকলেও লালপুর উপজেলায় গাছের সংখ্যা ও গুড় উৎপাদন হয় সবচেয়ে বেশি। উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা অঞ্চলে সড়ক ও রেল লাইনের দুই পাশে, জমির আইল, বাড়ির আঙ্গিনায় ছড়িয়ে আছে ৩ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ খেজুরের গাছ। এসব গাছ থেকে গুড় সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৫,০৭৯ টন। খেজুর গাছের রস সংগ্রহ কার্যক্রমে উপজেলার প্রায় ৩,০০০ পরিবার নির্ভরশীল।

 

এরপরেই রয়েছে বড়াইগ্রাম উপজেলা। সম্প্রতি বড়াইগ্রামে খেজুরের রস সংগ্রহ ও গুড় উৎপাদনকারী অর্ধশতাধিক গাছিকে নিয়ে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। উপজেলা কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানে এই কর্মশালার আয়োজন করে প্রাকৃতিক পুষ্টিযুক্ত মিষ্টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রুট বাংলাদেশ।

 

অযত্ন ও অবহেলায় থাকা এসব খেজুর গাছের কদর বাড়ে শীতকাল এলেই। খেজুরের গাছ অন্য কোনো ফসলের ক্ষতি করে না। এই গাছের জন্য বাড়তি কোনো খরচ গুনতে হয় না। ঝোপ-জঙ্গলে কোনো প্রকার যত্ন ছাড়াই বেড়ে উঠে খেজুর গাছ। শুধুমাত্র শীত মৌসুম এলে নিয়মিত পরিষ্কার করে রস সংগ্রহ করা হয়।

 

প্রতিদিন একজন গাছি প্রায় ৫০ থেকে ৫৫টি খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করে থাকেন। একজন গাছি শীত মৌসুমে ৭০ থেকে ৭৫ দিনে একটি খেজুর গাছ থেকে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ কেজি গুড় পেয়ে থাকেন। এছাড়া খেজুরের পাতা দিয়ে মাদুর ও গাছ কেটে ঘরের তীর তৈরি করা হয়।

 

নলডাঙ্গার বুড়ির ভাগ গ্রামের আহাদ আলী জানান, প্রতি বছর তিনি অন্তত ৭০ থেকে ৮০টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বাড়িতেই গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেন। কোনো কোনো সময় বাড়ি থেকেও গুড় বিক্রি হয়।

 

হলুদঘর গ্রামের খলিলুর রহমান জানান, প্রতি বছর প্রায় ১০০টির মত গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন। এবার আরও ১২০টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছেন। তিনি বলেন, “খেজুরের গুড় তৈরি ও বিক্রি করে আমার সংসার ভালোই চলে।”

 

লালপুর এলাকার আলাল হোসেন এবং মোজাফফর হোসেন জানান, লালপুর এলাকার খেজুরের গুড় প্রসিদ্ধ। এখানকার গুড় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই বাজারজাত করা হয়। কোনো কোনো সময় দেশের বাহিরেও পাটালি গুড় পাঠানো হয়।

 

তাদের দাবি, খেজুরের গুড়ের যেমন কদর আছে, সেই তুলনায় দাম আরও বেশি পাওয়া দরকার। কারণ উৎপাদন খরচ বেশি, পরিশ্রমও বেশি হয়। তাই এই গুড় বিক্রির একটি সঠিক প্লাটফর্ম তৈরি করা দরকার। বাজার ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাত করা গেলে এই গুড় শুধু দেশে নয়, বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এজন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

 

লালপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রীতম কুমার হোড় বলেন, “আমরা কৃষকদের খেজুরের গাছ লাগানোর জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকি। উপজেলার ৩,০০০ ব্যক্তি খেজুরের রস ও গুড় তৈরি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত।”

 

নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসার ফৌজিয়া ফেরদৌস বলেন, “খেজুরের রস দিয়ে সকালে মুড়ি খাওয়া, রস জ্বাল দিয়ে ভাপা পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। খেজুরের রস ও গুড় আমাদের ঐতিহ্য।”

 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নাটোর জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, “খেজুরের রস ও গুড় দু’টোই মানুষের কাছে খুব প্রিয় খাবার। খেজুরের রস ও গুড়কে ঘিরে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। প্রতিবছর জেলার ১০,০০০ ব্যক্তি খেজুরের রস দিয়ে গুড় উৎপাদন করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। নিরাপদ গুড় উৎপাদন এবং বিপণন ব্যবস্থাপনার মান-উন্নয়নে কৃষি বিভাগ নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।”

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *